ময়মনসিংহে শিশুরা চালাচ্ছে “পালকি”

প্রকাশঃ জুন ২১, ২০১৬ সময়ঃ ১২:১১ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৯:০৮ অপরাহ্ণ

প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ

1465654038_anik120160419165802

ময়মনসিংহ শহরের পথে লেগুনার মতো দেখতে এক ধরণের যাত্রীবাহী গাড়ি চলতে দেখা যায়। ‘পালকি’ নামের এসব গাড়ি রীতিমতো ঝকঝকে-তকতকে, কোন ভাঙ্গাচোরা নেই। কিন্তু ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, মাঝে মাঝেই এই পালকিগুলো চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে ছোট ছোট শিশু-কিশোরদের উপর।

ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে মাত্র ৫শ’ গজ আর নগরীর ২ নং পুলিশ ফাঁড়ি থেকে মাত্র ১শ’ গজ দূরে পালকির অবৈধ স্ট্যান্ডে হরহামেশাই তৈরি হচ্ছে অদক্ষ, অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের হাতে মৃত্যুর আয়োজন।

সপ্তাহ দু’য়েক আগে সড়ক দখল করে বসা রেজিস্ট্রেশনবিহীন যান পালকির অবৈধ স্ট্যান্ড সরিয়ে নিতে খোদ ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনারের কড়া নির্দেশনার পরও টনক নড়েনি জেলা পরিবহন মোটর মালিক সমিতির।

জানা যায়, স্থানীয় ট্রাফিক পুলিশকে ম্যানেজ করেই বিআরটিএ’র অনুমোদন ও রেজিস্ট্রেশনবিহীন প্রায় ৬০টি পালকি মাস ছয়েক ধরে নগরীর টাউন হল এলাকা থেকে প্রতিদিন ছেড়ে যাচ্ছে মুক্তাগাছা, রসুলপুর, অষ্টধর, পিয়ারপুর ও বিদ্যাগঞ্জসহ বিভিন্ন সড়কে। আর ওই সড়কে নিত্য যানজটও নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অনুমোদনবিহীন এসব গাড়ি থেকে মাসোহারা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে। আর ‘বখরা’ যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের এক শ্রেণির সুযোগ-সন্ধানী নেতাকর্মীদের পকেটে। অবৈধ এ কারবারের পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন জেলা পরিবহন মোটর মালিক সমিতির মহাসচিব মাহাবুবুর রহমান।

অথচ গত ৬ জুন এক সভায় ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার জিএম সালেহ উদ্দিন এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যস্ততম ওই সড়ক থেকে অবৈধ এ স্ট্যান্ড অন্যত্র স্থানান্তরের নির্দেশ দেন।

কিন্তু মোটর মালিক সমিতির নেতা মাহাবুবুর রহমানের অনিচ্ছার কারণেই বিভাগীয় কমিশনারের এমন আল্টিমেটামও কার্যত ফাঁকা বুলি হয়ে ঠেকেছে।

আবার, অবৈধ এ স্ট্যান্ডে শিশু শ্রমও লঙ্ঘিত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। স্ট্যান্ডে কর্মরতদের প্রত্যেকের বয়স ১০ কী ১২ বছর। বেশিরভাগ সময়ই তারা পালকির হেলপার হিসেবে কাজ করে। কিন্তু প্রায়শুই দেখা যাচ্ছে, কেউ পুরোদস্তুর চালক না হলেও মহাব্যস্ত চালকের পরিবর্তে নিজেরাই চরম ঝুঁকি নিয়ে ব্যস্ততম সড়কে পালকির দিক বদলের কাজ সারছে।

সরেজিমেন এ স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা গেলো, একটি গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে বসেছেন হাসান (১০) নামের এক শিশু। স্থানীয় অষ্টধরগামী একটি পালকির বদলি চালক কামাল হোসেন (৩৫) তখন কয়েক গজ দূরেই আড্ডাবাজিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন।

ওই চালকের নির্দেশেই গাড়ির দিক বদলের কাজটি সারছিলেন শিশু হাসান। তার পাশের আসনেও বসে ছিল আরেক কিশোর রিফাত (১৪)। আর গাড়ির বাম্পারে ঝুঁকি নিয়ে জেঁকে বসেছেন তাদের সঙ্গী কিশোর মঈন (১০)।

খানিক দূর থেকে এ ভয়ানক দৃশ্য দেখে এগিয়ে গেলে শিশু চালক হাসান (১০) বলেন, ‘ওস্তাদ (চালক) জিরাইতাছে (বিশ্রাম)। আমারে গাড়িডা ঘুরাইবার দায়িত্ব দিছে। আমার কাম (কাজ) গাড়ির হেল্পারি করা।’

শিশু হাসানের বাড়ি মুক্তাগাছার একটি গ্রামে। বাড়িতে ৬ ভাই-বোনের অভাবের সংসার। জীবিকা চালাতেই হাসান, জিহাদ, মঈনের মতো আরো অনেক শিশু-কিশোরেরই শৈশব বন্দি হয়ে পড়েছে ঝুঁকিপূর্ণ এমন কাজে।

এবার আড্ডাবাজি ফেলেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন চালক কামাল। হাসানকে পাশে বসিয়ে নিজেই চালকের আসনে বসে বললেন, ‘ও গাড়ি আঙ্গাইতাছে (এগুচ্ছে)। দুই মাস ধইরা ওরে স্টিয়ারিং ধরবার (ধরার) দিছি’।

‘দূরের পথ আমিই চালাই। মাঝে মধ্যে অগরে (ওদের) গাড়ি ঘুরাইবার (ঘুরাতে)-আঙ্গাইবার (এগুতে) দেই। এইটা তো দোষের কিছু না। অগরে আমরা ট্রেনিং দিতাছি (দিচ্ছি)।’

ব্যস্ত এমন সড়কে এ কাজ তো রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ, ফিরতি এ প্রতিবেদক এমন কথা বললে চেঁচিয়ে এগিয়ে আসেন এ স্ট্যান্ডের সুপারভাইজার পরিচয়দানকারী হানিফ (৪০)। ‘খুঁচাইন্না (খুঁচানো) যে, আমি কিন্তু ক্যাডার। সাংবাদিক মানমু না। যা কওয়ার (বলার) মহাসচিব মাহাবুব সাহেবরে কইন গা। আমি হের (তার) হুকুমের গোলাম।’

রমজান নামের আরেক সুপারভাইজার তার কথায় সায় দিয়ে বলেন, ‘খবর লেইক্ক্যা স্ট্যান্ড উঠানো যাইবো না। আমরা বিভাগীয় কমিশনার চিনি না। মালিক সমিতির মহাসচিবরে চিনি। উনি কইলে যামু গা। অন্য কেউ কইলে মানমু না।’

এসব বিষয়ে ময়মনসিংহের কোতোয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম বলেন, অবৈধ পালকি স্ট্যান্ড উচ্ছেদের নির্দেশনার কোনো রেজুলেশন এখনো পাইনি। পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর শিশুদের হাতে স্টিয়ারিং অবৈধ। খোঁজ খবর নিয়ে এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, অবৈধ পালকি স্ট্যান্ড উচ্ছেদে দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো শিশু চালক থাকলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

 

প্রতিক্ষণ/এডি/সাদিয়া

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G